ভ্যাকসিন বা টীকা আপনার পোষ্যের রোগপ্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। টিকা শুধুমাত্র আপনার পোষ্য বন্ধুর স্বাস্থ্য রক্ষা করে না, বরং অন্যান্য কুকুর, বিড়াল এবং এমনকি মানুষের মধ্যে রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করতেও সহায়তা করে।
ভ্যাকসিন সাধারণত ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল রোগের বিরুদ্ধে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য প্রদান করা হয়। কারণ, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া খুব দ্রুত সংক্রমিত হয় এবং ভাইরাস দ্বারা একবার আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি শতকরা ৮০ শতাংশেরও বেশি হতে পারে।
আমাদের দেশে শুধুমাত্র জলাতঙ্ক (Rabies) রোগেই প্রতি বছর ৬৬ শতাংশেরও বেশি কুকুর মারা যায়। সুতরাং, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে প্রিয় পোষ্যকে বাঁচাতে হলে সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে টিকা প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা সবাই জানি, “Prevention is better than cure”—অর্থাৎ রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ভ্যাকসিন বা টিকা কী?
ভ্যাকসিন হলো একটি নিরাপদ ও কার্যকরী জৈব রাসায়নিক যৌগ বা প্রস্তুতি যা শরীরে প্রবেশে করানোর পরে বহিরাগত কোন এক বিশেষ রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে একটি দৃঢ় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এবং রোগ সংক্রমণের প্রকোপ রুখে দিয়ে, প্রাণী দেহকে সুস্থ সবল রাখতে সাহায্য করে।
আমাদের দেশে কুকুর, বেড়ালকে সাধারণত ইঞ্জেকশন ও নাকে স্প্রে করানোর মাধ্যমে টিকা প্রদান করা হয়ে থাকে।
ভ্যাকসিন বা টীকা কতো প্রকার ও কি কি?
টিকা প্রধানত দুই প্রকারের। যেগুলি হলো –
- কোর ভ্যাকসিন অথবা মূল বা প্রধান টিকা (প্রতিষেধক)
- নন-কোর ভ্যাকসিন বা সেকেন্ডারি সহযোগী টিকা
কোর ভ্যাকসিন
কোর ভ্যাকসিনগুলি কুকুর, বেড়ালের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বাধ্যতামূলক। এই ভ্যাকসিন কুকুর এবং বেড়ালের যেকোনো পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। কোর ভ্যাকসিনগুলিকে সাধারণত মূল বা প্রধান ভ্যাকসিন হিসাবে মান্য করা হয়। যেটি প্রাণীদেরকে মারাত্মক ও প্রাণঘাতী রোগ থেকে রক্ষা করে এবং যার বিতরণ ও ব্যবহারের বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব রয়েছে।
কুকুরের কোর বা প্রধান ভ্যাকসিন গুলি যে রোগের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় সেগুলি হলো :
১. জলাতঙ্ক বা Rabies: এটি একটি মারাত্মক বা প্রাণনাশক ভাইরাল রোগ যেটি মুলত নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। এই রোগে আক্রান্ত কুকুর, বিড়াল এমনকি মানুষের মৃত্যুর হার ১০০ শতাংশ। জলাতঙ্ক রোগের বিরুদ্ধে Rabies ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
২. ডিসটেম্পার, হেপাটাইটিস, পারভো ভাইরাস, প্যারাইনফ্লুইয়েঞ্জা (DHPP): এটি একটি কম্বিনেশন ভ্যাকসিন বা যৌথ টিকা যেটি প্রধানত ডিসটেম্পার, হেপাটাইটিস, পারভো-ভাইরাস এবং প্যারাইনফ্লুইয়েঞ্জা এই চারটি রোগের বিরুদ্ধে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে ডিসটেম্পার, পারভো এবং প্যারাইনফ্লুইয়েঞ্জা ভাইরাস তিনটি সবচেয়ে বেশি সংক্রমক।
নন- কোর ভ্যাকসিন
নন-কোর ভ্যাকসিন সাধারণত ভৌগলিক অবস্থান, স্থানীয় পরিবেশ বা জীবনধারার সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, কোনো এক নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় যে রোগগুলির প্রকোপ বেশি এবং তাদের নির্দিষ্ট সংক্রমণের অধিক ঝুঁকি রয়েছে সেইসব এলাকার প্রাণনাশক রোগের বিরুদ্ধে এই ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়ে থাকে। কোর ভ্যাকসিনের মতো এটি বাধ্যতামূলক না হলেও, আমাদের দেশে নন-কোর ভ্যাকসিনের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
১. বোর্ডেটেলা (কেনেল কাফ/কাশি): এটি একটি তীব্র সংক্রমক রেসপিরেটরি (শ্বাসযন্ত্রের) ভাইরাস। সাধারণত ডগ পার্ক, ডগ কেনেল এবং ডগ ডে-কেয়ার সেন্টারে এই ভাইরাসের প্রকোপ খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
২. লেপটোস্পাইরোসিস: এটি একটি সংক্রমক ব্যাকটেরিয়াল ডিজিস। মাটি, মল ও ইউরিনের (মূত্র) মাধ্যমে সংক্রমিত হয় এবং এক দেহ থেকে অন্য দেহে ছড়িয়ে পরে। এই রোগ কিডনি (বৃক্ক) ও লিভারকে (যকৃত) ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৩. ক্যানাইন ইনফ্লুয়েঞ্জা: এটি তীব্র সংক্রমক ভাইরাস। এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত কুকুরের কাশি, নাক দিয়ে জল পড়া, জ্বর জ্বর ভাব বা অল্প মাত্রায় জ্বর দেখা দিতে পারে।
৪. লাইম ডিজিজ: এটি একটি টিক (এঁটুলি) দ্বারা বাহিত রোগ। Borrelua burgdorferi ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত টিক বা এঁটুলির কামড়ে এই রোগ ছড়ায়। এই রোগে শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, অলসতা, ক্ষুধামন্দা, পা দুর্বল ও খুড়িয়ে চলা, জ্বর ভাব এমনকি কিডনির সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
ভ্যাকসিনেশন বা টিকাপ্রদানের উপযুক্ত সময় কখন?
কুকুর ভ্যাকসিন বা টিকাকরণের তালিকা ও সময় সূচি
টিকা বা প্রতিষেধকের সময় সূচি কুকুরের বয়স, জীবন যাপন ও স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে।
কুকুর ছানার (Puppy) টিকা প্রদানের সময়সূচি:
06-08 Weeks | 10-12 Weeks | 14-16 Weeks | Annual |
Core Vaccines | Core Vaccines | Core Vaccines | Core Vaccines |
DHPPI* | DHPPI* | Rabies** DA2PP* | Rabies** DA2PP* |
Noncore Vaccines | Noncore Vaccines | Noncore Vaccines | Noncore Vaccines |
Bordetella Parainfluenza | Leptospirosis Lyme Canine Influenza | Leptospirosis Lyme Canine Influenza | Leptospirosis Lyme Canine Influenza Bordetella |
কুকুরের মতো বিড়ালেরও ভ্যাকসিনের প্রকার রয়েছে। বিড়ালের টিকা দুটি প্রধান বিভাগে বিভক্তঃ
কোর ভ্যাকসিন বা মূল টিকা
এই প্রয়োজনীয় টিকা সমস্ত বিড়ালের জন্য সুপারিশ করা হয়, তাদের জীবনধারা বা অবস্থান নির্বিশেষে।
কোর ভ্যাকসিন বা মূল টিকাগুলি নিম্নলিখিত রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করেঃ
১. রেবিস: একটি মারাত্মক ভাইরাল রোগ, যা স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
২. ফেলাইন ভাইরাল রাইনোট্রাকাইটিস (FVR): একটি অত্যন্ত সংক্রামক শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস।
৩. ফেলাইন ক্যালিসিভাইরাস (FCV): একটি অত্যন্ত সংক্রামক শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস।
৪. ফেলাইন প্যানলিউকোপেনিয়া (FPV): একটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং সম্ভাব্য প্রাণঘাতী ভাইরাস।
নন-কোর ভ্যাকসিন
জীবনধারা, অবস্থান এবং সংস্পর্শের ঝুঁকির মতো বিভিন্ন বিষয়ের ভিত্তিতে এই ভ্যাকসিনগুলো আপনার বিড়ালের নির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুসারে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
নন-কোর ভ্যাকসিনের মধ্যে রয়েছে:
১. ফেলাইন লিউকেমিয়া ভাইরাস (FeLV): এটি একটি ভাইরাল রোগ যা বিড়ালের ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়।
২. ফেলাইন ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (FIV): এটি আরেকটি ভাইরাল রোগ যা বিড়ালের ইমিউন সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।বিড়ালের টিকাদান সময়সূচি তার বয়স, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। নিচে একটি সাধারণ সময়সূচির রূপরেখা দেওয়া হলো।
বিড়ালছানা টিকাদানের সময়সূচি:
- প্রথম টিকা (FVR, FCV, FPV): ৬-৮ সপ্তাহ
- দ্বিতীয় টিকা (FVR, FCV, FPV): ১০-১২ সপ্তাহ
- তৃতীয় টিকা (FVR, FCV, FPV): ১৪-১৬ সপ্তাহ
- চতুর্থ টিকা, রেবিস টিকা: ১২-১৬ সপ্তাহ
- বুস্টার শট: প্রাথমিক টিকার ১ বছর পর
প্রাপ্তবয়স্ক বিড়ালের টিকা দেওয়ার সময়সূচী:
বুস্টার শট: প্রায় 1-3 বছর, ভ্যাকসিন এবং এক্সেপোজারের ঝুঁকির উপর নির্ভর করে বিড়াল টিকাদানের উপকারিতা।
06-08 Weeks | 10-12 Weeks | 12-16 Weeks | 14-16 Weeks | After 1st Vaccine |
FVR | FVR | Rabies** | FVR | Booster |
FCV | FCV | FCV | ||
FPV | FPV | FPV |
কুকুর ও বিড়ালের টিকাকরণের সুবিধা :
কুকুর ও বিড়ালের টিকা প্রদানের অসংখ্য সুবিধা বা বেনিফিট আছে। যেমন –
১. সংক্রমণের বিরুদ্ধে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা :
টিকাকরণের ফলে কুকুর ও বিড়ালের শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি হয় যা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াল রোগের বিরুদ্ধে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়।
২. সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকে : ভ্যাকসিনেটেড বা টিকা প্রাপ্ত কুকুর টিকাহীন অন্য কুকুরের তুলনায় খুবই কম রোগ বহন করে এবং তাদের দ্বারা সংক্রমণের ঝুঁকিও অনেকাংশে কম।
৩. মহামারী প্রতিরোধ: বিশ্বব্যাপী টিকাকরণের ফলে কুকুর ও বিড়ালের মহামারী বা আউটব্রেক প্রতিরোধ সম্ভব।
৪. জনস্বাস্থ্য উন্নতি: কুকুর ও বিড়ালের টিকাকরণের মাধ্যমে কুকুরের দেহ থেকে মানুষের দেহে সংক্রামিত অর্থাৎ জুনোটিক রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। যেমন, জলাতঙ্কল বা রেবিস একটি জুনোটিক রোগ।
টিকার ঝুঁকি ও পার্শ প্রতিক্রিয়া: যদিও টিকাকরণ সাধারণত অনেকটাই নিরাপদ তবুও কুকুর ও বিড়ালের টিকা প্রদানের পর কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা বা সেই বিষয়ে কিছু ধারণা থাকা উচিৎ।
সাধারণ পার্শ প্রতিক্রিয়া: জ্বর জ্বর ভাব, অলসতা এবং ইঞ্জেকশনের জায়গায় অল্প পরিমাণ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
এ্যালার্জি: টিকা প্রদানের পর এ্যালার্জি খুবই কম দেখতে পাওয়া যায়। তবে কোন কোন কুকুর ও বিড়ালের পূর্বে এই ধরনের সমস্যা থাকলে সেক্ষেত্রে এ্যালার্জি জনিত পার্শ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে এমনকি এটা সাংঘাতিক আকারও ধারণ করতে পারে। সেই জন্য ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদানের পূর্বে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
টিকা জনিত রোগ: টিকা প্রদানের ফলে অটোইমিউন রোগ হতে পারে তবে এটি হওয়ার সম্ভব খুবই কম। কিছু কিছু কুকুর ও বিড়ালের ক্ষেত্রে চুলকানি লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া টিকা ঠিক মতো না দিতে পারলে টিকা প্রদানের জায়গাটিও ফুলে উঠতে পারে।
কুকুর ও বিড়ালের টিকা প্রদান দায়িত্বশীল পোষ্য পালনকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। টিকার গুরুত্ব, উপলব্ধ ভ্যাকসিনের প্রকার এবং প্রস্তাবিত টিকার সময়সূচি সম্পর্কে অবগত হওয়া, আপনাকে আপনার কুকুর বা বিড়ালকে সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা করতে এবং তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে। আপনার কুকুর বা বিড়ালের জন্য সঠিক টিকা পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে আপনার পশুচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
Meet Dr. Newton Bala, a compassionate and experienced veterinarian dedicated to providing top-notch care for your beloved pets. With 7 plus years of experience and a passion for animal welfare. Dr. Bala is a highly qualified veterinarian with B.V.Sc & A.H, M.V.Sc degree from WEST BENGAL UNIVERSITY OF ANIMAL AND FISHERY SCIENCES (WBUAFS). He is also certified in Soft tissue surgery and ABCP with a strong foundation in veterinary medicine.